সুনামগঞ্জ , মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ , ২৫ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবার হাওরে বিশ্ববিদ্যালয়! জমিয়তের অপরাংশের নেতা আব্দুল হাফিজ গ্রেফতার, সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন তাহিরপুরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের দায়ে ৩ জনের কারাদণ্ড বিশ্বম্ভরপুরে টাস্কফোর্স অভিযানে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় পণ্য জব্দ ক্ষোভ-শোক-প্রতিবাদে ফুঁসছে জনতা টাঙ্গুয়ার হাওরে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন ট্যুরিজমে’ মনঃক্ষুণ্ণ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণের ঘটনার তদন্ত ও আইসিইউ চালুর দাবি পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপিত তাহিরপুরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের দায়ে ১৬ জনের কারাদণ্ড জামালগঞ্জে “হাওর বাঁচাও আন্দোলনের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন ৩ দিন ধরে নিখোঁজ, নদীতে মিলল জমিয়ত নেতার মরদেহ সীমান্তে ২৩টি ভারতীয় গরু জব্দ দিরাইয়ে তিন ভাগে বিভক্ত বিএনপি শীঘ্রই একটি নির্দিষ্ট সময় হাওরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে : উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ঈদে মিলাদুন্নবীর গুরুত্ব ও তাৎপর্য সুনামগঞ্জ-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো অবৈধ স্থাপনা দিরাইয়ে বিএনপি’র শোভাযাত্রায় নেতাকর্মীদের ঢল দিরাইয়ে বিএনপির দু’পক্ষের সংঘর্ষে আহত ৩ দুই ছাত্রীকে অপহরণ, নির্যাতন ও ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ দায়িদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিতে জুডিসিয়াল তদন্ত কমিটি গঠন

পথে যেতে যেতে:পথচারী

  • আপলোড সময় : ০৯-০৯-২০২৫ ০৯:২৮:৪২ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ০৯-০৯-২০২৫ ০৯:২৮:৪২ পূর্বাহ্ন
পথে যেতে যেতে:পথচারী
অপরূপ ঋতু বৈচিত্রের দেশ বাংলাদেশ। বছরের বারোমাস এখানে চলে প্রকৃতির লীলাখেলা। কখনো হাঁসফাঁস করা প্রচ- গরম, কখনো হাড় কাঁপানো শীত, কখনো অঝোর ধারায় বৃষ্টি, বর্ষা-বন্যা-খরা আবার কখনো মৃদুমন্দ বায়ে দোলে শুভ্রনীল আকাশ। প্রকৃতির এই বৈচিত্রপূর্ণ আচরণকে ছয় ভাগে ভাগ করেছেন প্রকৃতিপ্রেমিরা। ঋতুচক্রক্রম অনুসারে প্রথম দুটি ঋতু গ্রীষ্ম ও বর্ষা এবং তারপর তৃতীয় ঋতু শরৎ। ভাদ্র ও আশ্বিন এ দু’মাস শরৎকাল। বর্ষার ঝরো ঝরো বৃষ্টি পথঘাট ভিজিয়ে দিয়ে খাল-নদী-বিল যখন একাকার করে তোলে তখন বৃষ্টির তীব্রতা কমিয়ে আকাশের গুমরো মুখ বিদূরিত করে শুভ্রনীল রূপ নিয়ে যে ঋতুটি আসে সে আর কেউ নয় আমাদের প্রিয় শরৎ ঋতু। ভেজা পথঘাট ধীরে ধীরে শুকোতে আরম্ভ করে, খালবিলের পানি সরে যেতে থাকে, জেগে ওঠে ডুবে যাওয়া জমির আইলগুলো। যে কৃষক হাতের কাজ ফেলে বসেছিল ঘরের কোণে সে আজ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে বাইরে। বর্ষার ভেজা আবহাওয়ায় যে ফসল কোনরকম টিকেছিল আজ তা হাত পা ছুঁড়ে দিয়েছে মনের উচ্ছ্বাসে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১ খ্রিঃ) তাঁর কবিতায় শরৎ ঋতুর অনুভবকে এভাবে ব্যক্ত করেন, ‘শরৎ রাণীর বীণা বাজে কদমতলে/ললিত রাগের সুর ঝরে তাই শিউলিতলে/ তাইতো বাতাস বেড়ায় মেতে কচি ধানের সবুজ ক্ষেতে, বনের প্রাণে মরমরাণি ঢেউ উঠালে।’ বর্ষায় মেঘ ছিল আকাশজুড়ে কালো হয়ে। শরতে মেঘ এলো শুভ্র পেঁজা পেঁজা। কখনো হালকা নীল আকাশ উঁকি দেয় ঝলমলিয়ে। এ যেনো মেঘ ও রোদের লুকোচুরি খেলা। আলোর স্বর্ণচ্ছটায় আকাশ তখন ডাকে তার রূপ মাধুরীকে উপভোগ করতে। কিন্তু, ক’জনইবা বোঝে সেই ভাষা? কবিরা ঠিকই বোঝেন শরৎকে। খুশিতে ভরপুর শরৎ নিয়ে কবি লিখেন, ‘শরৎ, তোমার শিশির ধোওয়া কু-লে / বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে / আজ প্রভাতের হৃদয় উঠে চঞ্চলি।’ হালকা শিশির, হালকা মেঘ, হাসিমাখা সকাল, চারিদিকে শুভ্র হাসির দোলা, এক ঝলক হাওয়া, গাছে গাছে পাতার ফাঁকে রোদের ঝিকিমিকি, চপল ছন্দে টুকরো টুকরো মেঘ ভেসে চলা সব মিলিয়ে মনে হয় ‘আমার সোনা রোদের গান’। পূর্বাশার দুয়ার আলোকিত করে আসা শরৎ আমাদের উপহার দেয় নানা প্রকৃতির ফুল। বনে বনে তখন ফুটে থাকে শেফালি, কামিনী, মালতী, জুঁই, টগর প্রভৃতি শারদীয় ফুল। রজতশুভ্র জোছনায় পুষ্প সুষমা নিয়ে অফুরান কাকলি আর গানে গানে মুখরিত হয়ে আসে শরৎ। ‘মনসা মঙ্গল কাব্য’-এর রচয়িতা মহাকবি কালিদাস (আনুমানিক ১৬৭৭-১৭২২ খ্রি.)-এর বর্ণনায় শরৎ হচ্ছে কাশফুলে ছাওয়া নদীর দু’কূল, হাওয়ার দুলে ওঠা ধানের শীষ, বাতাসে ভেসে বেড়ানো শিউলী ফুলের মৃদুমন্দ গন্ধ এবং নীড় ছেড়ে পাখিদের মুক্ত আকাশে ঘুরে বেড়ানো। কবিরা যেহেতু প্রকৃতিপ্রেমি তারা প্রকৃতিকে উপলব্ধি করেন গভীরভাবে। শরতের শ্যামলিমায় রাতের যে জ্যোৎ¯œাধারা তা কবিকে আপ্লুত করে। মন চায় বাইরে ঘুরে বেড়াতে। পাখিরা যেমন উড়ে বেড়ায় আকাশে তেমনি। অনেক সময় রাত্রি শেষ না হতেই পাখিরা ডেকে ওঠে সমস্বরে। ভ্রম হয় তাদের। শরতের জ্যোৎ¯œা এমনি বিভ্রান্তিতে ফেলে তাদের। দেখা যায় ভোরের কাক ডেকে ওঠে মাঝ রাতে। এ সময় বনে বনে ঝরে পড়ে শিউলিরা। শিশিরসিক্ত সবুজ ঘাস। জুঁই মালতীর বোটায় শিশির বিন্দু জমা হয়ে টলমল করে ওঠে। দেখে চঞ্চল হয়ে ওঠে কবি হৃদয়। কবির লেখনীতে আমরা পাই, “আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালি মালা/ নবীন ধানের মঞ্জুরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা। (গীতাঞ্জলি - রবীন্দ্রনাথ)। শরৎ আসলে প্রাণের ঋতু। কৃষকের লাঙ্গলের ফলায় যে সবুজাভ পেহ্বলতা তৈরি হয় তা অন্য ঋতুতে হয়না। শিউলী ফোটে এ ঋতুতেই। মৃদু মর্মর গান, গহন মেঘমালা বারবার অবগুণ্ঠন খুলতে আহ্বান জানায় এই ঋতুতেই। কবির ভাষায় বর্ণনা এ রকম, ‘এবার অবগুণ্ঠন খোল/ গহন মেঘ-মায়ায় বিজন বন ছায়ায়/ তোমার আঁচলে অবগুণ্ঠন সারা হল / শিউলী সুরভী রাত বিকশিত জোছনাতে মৃদু মর্মর গানে তবমর্মের বাণী বোলো।’ শরৎকালে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক ধর্মীয় উৎসব পালিত হয়ে থাকে। দুর্গাপূজা এ ধরনের উৎসবের মধ্যে অন্যতম। আছে লক্ষ্মীপূজা। শারদীয় দুর্গা উৎসব সমাজে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে মিলন ঘটায়। এ সময় প্রকৃতিতে আর ও একটি সংযোজন লক্ষ করা যায়। সেটি হচ্ছে পুকুর খাল বিলে পদ্ম ফুল ফোটে। শাপলা এবং নীল ফুলে ছেয়ে যায় জলাধার। এমনি অবস্থায় কবির লেখনিতে আসে, ‘আজি কি মধুর মুরতি / হেরিনু শারদ প্রভাবে/ হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ ঝলিছে অমল শোভাতে/ পারেনা বহিতে নদী জলাধার/ মাঠে মাঠে ধান ধরে নাকো আর / ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল তোমার কানন সভাতে/ মাঝখানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী শরৎকালে প্রভাতে (রবীন্দ্রনাথ)। শরৎকে নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের অনেক অনুভূতি আছে। যেমন তিনি বলছেন, আজ শরতের আলোয় এইযে চেয়ে দেখি/ মনে হয় এযেন আমার প্রথম দেখা। আমি দেখলাম নবীনকে/ প্রতিদিনের ক্লান্ত চোখ যার দর্শন হারিয়েছে। শরৎ ঋতুর রূপ মহিমা বর্ণনা করতে গিয়ে অভিভূত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু কবিতায়ই নয় সাহিত্যের আরও অনেক শাখায় শরতের বর্ণনা দিয়েছেন। কেননা কাশবন বাঁশবন, ঢেউ দোলানো সবুজ প্রান্তর, বৃক্ষশীর্ষ গৃহচূড়া, ভরা জ্যোৎ¯œা লেখক মাত্রকেই দোলা দেয়। রবীন্দ্রনাথের পরিচয় উপন্যাসে শরৎ ঋতুর বর্ণনায় আমরা পাই, ‘আমাদের শরৎ শিশু মূর্তিধরিয়া আসে। সে একেবারে নবীন বর্ষার গর্ভ হইতে এইমাত্র জন্ম লইয়া ধরণী-ধাত্রীর কোলে শুইয়া হাসিতেছে। শরতের রংটি প্রাণের রং। অর্থাৎ তাহা কাঁচা, বড় নরম। রৌদ্রটি কচি সোনা, সবুজটি কচি, নীলটি তাজা।’ রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও আরও অনেক কবির রচনায় শরৎ ঋতুর রূপটি বর্ণিত হয়েছে। কবি দ্বীজ চ-ীদাস শরৎ ঋতু বিষয়ক ভাবনায় বলছেন, ‘শারদ পূর্ণিমা নিরমল রাতি / উজল সকল বন/ মল্লিকা মালতী বিকশিত তথি/ মাতল ভ্রমরাগণ। প্রাচীন যুগের কবি কালিদাস-এর প্রথম জীবনের কাব্যগ্রন্থ ‘ঋতু সংহার’-এর শরৎ ঋতু সম্পর্কে এরকম বর্ণনা পাওয়া যায় “কাশাংশুকা বিকচ পদ্ম মনোজ্ঞ বস্ত্র / সোন্মাদহংসরব নূপুর নাদরম্যা/ আপক্ক শালিরুচিরা তনুগাত্র ষষ্টি/ প্রাপ্ত শবন্ন বধুবির রূপবম্যা।” অর্থাৎ ‘কাশফুল যার বস্ত্র প্রস্ফুটিত পদ্ম যার মুখ, উন্মত্ত হংস কাকলী যার নূপুর ধ্বনি। ঈষৎ পক্ক শালিধান্য যার দেহপষ্টি সেই শরৎকাল সুন্দর নববধূ বেশে এসে উপস্থিত হয়েছে। ইংরেজি কবি পিবি শেলী লিখেছেন, ঞযব ধিৎস ংঁহ রং ভধরষরহম, ঃযব নষববশ রিহফ রং ধিরষরহম/ ঞযব নধৎব নড়ঁমযং ংরমযরহম, ঃযব ঢ়ধষব ভষড়বিৎং ধৎব ফুরহম./ ঙহ ঃযব বধৎঃয যধফ ফরধঃয নবফ ধহফ ঃযব ুবধৎ রহ ধ ংযৎড়ঁহফ ড়ভ ষবধাবং ফরধফ/ রং ফুরহম; অর্থ্যাৎ উষ্ণ সূর্যকিরণ কম হয়ে এসেছে, তীব্র ঠা-া বাতাস আর্তনাদ করে ফিরছে/ দেউলে কুঞ্জবন দীর্ঘশ^াস ফেলছে, বিবর্ণ ফুল ঝরে ঝরে পড়ছে। পৃথিবী হয়েছে মৃত্যুশয্যা, ঝরা পাতার শবাচ্ছাদানীতে ঢেকে বছর শুয়ে আছে।’ অনুরূপ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ, জন কীট্স্ হুড প্রমুখ কবিরা তাদের রচনায় শরৎকে তুলে ধরেছেন যর্থার্থ অর্থে।’ অনেকেরই অনুভূতিতে শরৎ ঋতু প্রাণের ঋতু হয়ে ধরা দিয়েছে। অন্যান্য ঋতু সমূহের যেমন নিজস্বতা রয়েছে, ঠিক তেমনি নিজস্বতা রয়েছে এই শরৎ ঋতুরও। বৃষ্টির ব্যাপকতা নেই বন্যার ভয় নেই, কৃষক স্বস্তিতে, কাশবনে শুভ্র রং লেগেছে, ধানের কচি চারায় আগমনী বার্তা, শিউলী জাতীয় ফুলের সমারোহ সব মিরিয়ে অনন্য এক রূপ প্রকৃতির যা অন্য কোনো ঋতুতে পাওয়া যায় না। তাই চিন্তা চেতনায়, অনুভূতি ভাবনায় এমনকি আন্দোলিত হৃদয়ে অনন্য এক ঋতুর নাম শরৎ। কবিতার ভাষায় বলা যায়, আমার নয়ন ভোলোনো এলে আমি কী হেরিরাম নয়ন মেলে/ শিউলীতলার পাশে পাশে ঝরা ফুলের রাশে রাশে/ শিশির ভেজা ঘাসে ঘাসে তরুণ রাঙা চরণ ফেলে/ নয়ন ভোলানো এলে।’ আমরা শরৎকে বরণ করবো আবার বিদায় জানাবো সময় হলে। এটিই ঋতুর মাহাত্ম। শরৎ ঋতুর সকল সুধারস আস্বাদনে আমরা উজ্জীবিত হবো এবং পার্থক্য নির্ণয় করবো অন্য সকল ঋতুর সাথে। গভীর নয়ন মেলে অনুসন্ধান করলে এর আরও অনেক গোপনীয় লুকায়িত সৌন্দর্য্যের কথা আমরা জানতে পারবো। মনের আনন্দের জন্য সাহিত্যের ভা-ারকে সমৃদ্ধ করার জন্য প্রয়োজন এমনই অনুসন্ধান। আজকাল নগর জীবনে সবকটি ঋতুর বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান হয় না। এটি প্রকৃতির অভিশাপ। আমরা নিজেরাই এর জন্য দায়ী। পৃথিবীর খুব কম দেশ আছে যে দেশে ষড়ঋতুর প্রভাব প্রচ্ছন্ন। তার মধ্যে বাংলাদেশ অনন্য। এমনই এক ঋতুর পরশ পেয়ে আমরা যে ধন্য একথা নির্বিঘ্নে বলা যায়।

নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha

কমেন্ট বক্স
সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবার হাওরে বিশ্ববিদ্যালয়!

সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবার হাওরে বিশ্ববিদ্যালয়!